নারায়ন নিচ্ছে লক্ষ্মীর ভান্ডার, শোরগোল গড়বেতা তিন নম্বর ব্লক জুড়ে
সুমন পাত্র, চন্দ্রকোণা রোড: মহিলাদের জন্য ‘লক্ষ্মীর ভাণ্ডার’ প্রকল্প চালু করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অথচ দীর্ঘ প্রায় তিন বছর ধরে সেই টাকাই ঢুকছে এক পুরুষের অ্যাকাউন্টে। অপরদিকে বঞ্চিত প্রকৃত প্রাপক। শুধু তাই নয়, একই অ্যাকাউন্টে ঢুকছে বার্ধক্য ভাতা, পিএম কিষানের টাকাও।
গড়বেতা-৩ ব্লকের এহেন ঘটনায় দুর্নীতির গন্ধ পেতেই তদন্ত শুরু করেছে প্রশাসন।
২০২০-’২১ সালে বার্ধক্যভাতার জন্য আবেদন করেন গড়বেতা-৩ ব্লকের সাতবাঁকুড়া পঞ্চায়েতের তুঁতবাড়ি গ্রামের ভারতী পাল। অনুমোদনও মেলে। তবে, আজ পর্যন্ত ভাতার এক টাকাও তিনি পাননি। এনিয়ে বহুবার তিনি পঞ্চায়েত, বিডিও অফিসে গিয়েছেন। ভাতার টাকা কেন ব্যাঙ্কে ঢুকছে না, জিজ্ঞাসা করলেই সংশ্লিষ্ট দপ্তরের সরকারি কর্মীরা জানিয়েছেন, টাকা আপনার অ্যাকাউন্টেই ঢুকছে। ব্যাঙ্কে যোগাযোগ করুন। ব্যাঙ্কেও গিয়েছেন তিনি। কিন্তু, সেখান থেকে সাফ জানানো হয়, আপনার অ্যাকাউন্টে কোনও টাকা ঢুকছে না। গত তিন বছর ধরে পঞ্চায়েত অফিস, বিডিও অফিস, ব্যাঙ্কে ঘুরেও কোনও সুরাহা হয়নি। অবশেষে তিনি জানতে পারেন, তাঁর টাকা ঢুকছে ওই ব্লকেরই ছোট ডাবচা গ্রামের বাসিন্দা গোরাচাঁদ কুণ্ডু নামের এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে।
বৃদ্ধার নাতি সৌভিক পাল বলেন, ‘ঠাকুমার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢুকছে না দেখে মঙ্গলবার আমি পঞ্চায়েত দপ্তরে গিয়ে সমস্ত তথ্য বের করি। দেখি ঠাকুমার প্রাপ্য ভাতার টাকা তাঁর ব্যাঙ্কে না ঢুকে গোরাচাঁদ কুণ্ডু নামে এক ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে ঢুকছে। বিষয়টি লিখিত আকারে বিডিওকে জানিয়েছি। ঘটনার কথা পঞ্চায়েতেও জানিয়েছি।
এরপরেই ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট ডিটেলস যাচাই করেন আধিকারিকরা। তা করতে গিয়ে তাঁদের চক্ষু চড়কগাছ হয়। দেখা যায়, শুধু বার্ধক্যভাতার টাকাই নয়, প্রতি মাসে নিয়ম করে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, এমনকী পিএম কিষান প্রকল্পের টাকাও ঢুকছে ওই ব্যক্তির অ্যাকাউন্টে। অর্থাৎ, তিনটি সরকারি প্রকল্পের টাকা ঢুকছে একজনেরই অ্যাকাউন্টে। সাতবাঁকুড়া পঞ্চায়েতের প্রধান মণিকাঞ্চন রায় বলেন, ঘটনাটি জেনেছি। অভিযোগও পেয়েছি। এধরনের ঘটনা কখনওই সমর্থনযোগ্য নয়। ঘটনার তদন্ত করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
তবে, এটি কোনও বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, মঙ্গলবার এধরনের আরও একটি ঘটনা সামনে আসে। আড়াবাড়ির বাসিন্দা স্বপন রায়ও দীর্ঘদিন ধরেই ভাতার টাকা পাচ্ছিলেন না বলে অভিযোগ। তদন্ত করে দেখা যায়, তাঁর প্রাপ্য টাকা নিয়মিত ঢুকছে ছেলে সুজিত রায়ের অ্যাকাউন্টে। কিছুমাস আগে এধরনের আরও একটি ঘটনা ঘটে। ওই ব্লকেরই দ্বারিগেড়িয়ার এক ব্যক্তির বার্ধক্য ভাতার টাকা পাচ্ছেন না বলে অভিযোগ করেন পঞ্চায়েতে। সেই ঘটনার ক্ষেত্রেও তদন্তে নেমে দেখা যায়, টাকা ঢুকছে মেদিনীপুর শহরের রাঙামাটির এক মহিলার অ্যাকাউন্টে। তাঁর অ্যাকাউন্ট যাচাই করে দেখা যায়, একসঙ্গে চারটি ভাতার টাকা ঢুকছে ওই অ্যাকাউন্টে। অর্থাৎ, এধরনের ঘটনায় স্পষ্ট, প্রাপ্যকে বঞ্চিত করে ভাতার টাকা নয়ছয় হচ্ছে। এর পিছনে একটি চক্র কাজ করছে বলে অনুমান পদস্থ আধিকারিকদের। সরকারি দপ্তরের নিচুতলার কর্মীদের একাংশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে।
এই ঘটনায় ক্ষুব্ধ জেলাশাসক খুরশিদ আলি কাদরি। তিনি বলেন, ঘটনা তদন্ত করে দেখা হবে। দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। এরপরেই বিডিও অভিযুক্ত ব্যক্তির নামে থানায় অভিযোগ করে তারপরেই সক্রিয় হয়ে উঠে পুলিশ অভিযুক্ত ব্যক্তিকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করে সদর্থক উত্তর না পেয়ে গ্রেফতার করে।
এই ঘটনার জেরে যথেষ্ট চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়ে গড়বেতা তিন নম্বর ব্লকে। বিজেপির অভিযোগ করা হয় তৃণমূল কংগ্রেস মানেই দুর্নীতি তৃণমূল কংগ্রেস মানেই চুরি।
অপরদিকে শাসক দলের পক্ষে জানানো হয়েছে ঘটনায় শাসক দলের সঙ্গে কোন যোগ নেই এটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা অভিযুক্ত ব্যাক্তির বিরুদ্ধে কড়া প্রশাসনিক ও আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
গড়বেতা তিন নম্বর ব্লকের বিডিও এই ঘটনার পরে আট জনকে শো-কজ করেছে। এবং ব্লক প্রশাসনের তরফে জানানো হয়েছে যে সমস্ত প্রকল্পের উপভোক্তাদের সকল তথ্য পুনরায় যাচাই করে আবার দেখা হবে। সেই মতো তিনি এদিন প্রয়োজনীয় নির্দেশ দেন।